Saturday, July 19, 2008

কুড়িগ্রাম.............বিপ্লবী আন্দোলন........

কৈবর্ত বিদ্রোহ ,সন্ন্যাসী -ফকির বিদ্রোহ, রায়ত বিদ্রোহ প্রভৃতি গন আন্দোলনের ইতিহাসে অবিভক্ত ভারতের রংপুর জেলার এক বিশেষ ভুমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তুলনামুলক আধুনিক কালে ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন সংগ্রামেও রংপুর জেলার অবদান কম নয়।রংপুর শহরে কংগ্রেস এর শক্তিশালী সংগঠন এবং কর্মকান্ড ছিল।কুড়িগ্রাম মহকুমা,উলিপুর,নুনখাওয়া প্রভৃতি স্থানে কংগ্রেসের অনেক নেতা ও কর্মীরা আন্দোলন পরিচালনা করতেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে বেকার সমস্যা তীব্র ভাবে দেখা দেয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের বিভিন্ন অংশ -ছাত্র,শিক্ষক ,উকিল,ব্যারিস্টার,কেরানি, সকলেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হন।এঁদের এক অংশ অবশ্য কংগ্রেস পরিচালিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে থাকলেন না-কেবল মাত্র বিলাতি পন্য বর্জনের আন্দোলনে নিজেদের সীমাবধ্য রাখলেন না,বিলাতি শাসন ও বর্জন করার তাগিদ অনুভব করলেন।
এই প্রেক্ষিতে বাঙ্গলায় শুরু হল এক বিশেষ ধরনের আন্দোলন যাকে প্রশাসন সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনের অভিধায় অভিহিত করল।ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রগতিশীল এবং মার্কস বাদি বুদ্ধিজীবী ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ এর মতে কংগ্রেসের আন্দোলন থেকে ভিন্নধর্মি হলেও এই আন্দোলন টি ছিল জাতীয় মুক্তিআন্দোলনের-ই এক বিশেষ ধারা।
কুড়িগ্রামেও যে এই বিপ্লববাদীরা যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন তার প্রমান রয়ে গেছে প্রশাসনের বিভিন্ন গোপন নথীপত্রে,ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবীদের লেখায়।এই রকম-ই এক বিপ্লবী ছিলেন সুধীর মুখার্জী। যদিও তাঁর জন্ম স্থান ছিল পূর্বতন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলে,তাঁর শৈশব ও বিদ্যালয় জীবন কেটেছে কুড়িগ্রাম।১৯২১ সালের বিপুল জাতীয় অভ্যুথ্থান তাঁর জীবনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র থাকাকালীন তিনি বিপ্লবীদলের কিরণদাস,জগদীশ মজুমদার প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন।অনুশীলন সমিতির ত`ৎকালীন ছাত্রযুবনেতা বীরেন দাসগুপ্তের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে।১৯২৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি ঢাকায় চলে যান ।সেখানে শ্রীসঙ্ঘের পার্টির ছেলেদের সাথে পরিচয় হয় এবং প্রয়াত অনিল রায়ের সংস্পর্শে আসেন।পরবর্তি সময়ে তিনি কাশীতে পড়তে যান।পুনরায় তিনি কুড়িগ্রামে ফিরে আসেন এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহন করেন । এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে কুড়িগ্রামে যুগান্তর দল ও যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয়েছিলো।
'রংপুরের আধিয়ার বিদ্রোহ ও তেভাগা আ ন্দোলন'-(সংকলক:শ্রী ধনঞ্জয় রায় রত্না প্রকাশন,১৪/১ পিয়ারীমোহন রায় রোড,কলিকাতা-৭০০০২৭) গ্রন্থ থেকে জানা যায় -
রংপুর জেলাএককালে ছিল উত্তরবঙ্গ যুববিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্র ।বিপ্লবী আন্দোলনের গোড়া থেকে এই জেলাতে অনুশীলন সমিতির বিস্তৃত কাজ ছিল। সতীশ পাকড়াশী সে যুগে দীর্ঘকাল রংপুর জেলাকে কেন্দ্র করে কাজ করেছিলেন । গোপন অবস্থায় তিনি গ্রামে- গঞ্জে ঘুরেছেন। পরবর্তী যুগে যুগান্তর দল বিশেষ শক্তিশালী হয়েছিল।ঢাকার শ্রীসঙ্ঘ ও বি ভি দলের কিছু কাজ ছিলএখানে।শহিদ প্রফুল্ল চাকির বাড়ি ছিল বগুড়া।তিনি রংপুর এ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী চিলমারী বন্দরে ছিলেন।বিখ্যাত রডা রিভলভার অপসারণের সাথে জড়িত সুরেন বর্ধন ছিলেন নাগশ্বরিগঞ্জের বিশিষ্ট অধিবাসী।রংপুর শহরের বিখ্যাত আইনজীবী সতীশ চক্রব্তী মহাশয় শহীদ ক্ষুদিরামের মামলায় তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন।১৯৩০ এর দশকে বহু বিপ্লবী কর্মী বিনা বিচারে আবদ্ধ ছিলেন।অনেকে রাজদ্রোহমূলক বিভিন্ন মামলায় সাজা প্রাপ্ত ছিলেন।প্রসঙ্গক্রমে কুড়িগ্রামের অমরেন্দ্রপ্রসাদ (যিনি কালা লাহিড়ী নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন) এর আত্মকথন উল্লেখ করা যেতে পারে।তিনি লিখছেন-"সপ্তম শ্রেনীতে যখন পড়ি তখন নির্দিষ্ট একটি ব্যায়াম সমিতিতে যাইতে থাকি।ইহার এক ব`ৎসর পর মনে পড়িতেছে উক্ত ব্যায়াম সমিতির বৈপ্লবিক উদ্দেশ্যের সহিত অল্প অল্প সংযুক্ত হইয়া পড়িতেছিলাম। আস্তে আস্তে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের নজরে আসিয়া গিয়াছি। প্রকাশ্যে আমরা নানারূপ জনহিতকর এবং সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করিতাম। ১৯৩৩-৩৪ সনে আমাদের চতুর্থ ভ্রাতাকে (রবীন্দ্র প্রসাদ লাহিড়ী)কে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যায়।ইতিমধ্যে আমাদের পিতা চাকুরি ত্যাগের সঙ্কল্প কাজে পরিনত করিয়া আমাদের পারিবারিক বাড়ি পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার শাহাজাদপুর থানার অন্তরগত ব্রাহ্মণগ্রামে পাঠাইয়া দেন।নুনখাওয়া হৈতে হাজ়ার মনের নৌকায় সাতদিনের ভ্রমণের কথা এখনো মনে উত্তেজনার সঞ্চার করে।
পাবনার বাড়ীতে পৌঁছিবার পর আমার এবং ৪র্থ ভ্রাতা রবির উপর গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করিয়া অন্তরীণ এর আদেশ জারী করা হয়।ঐ সময় আমরা বাড়ি হইতে প্রতি সপ্তাহে শাহাজাদপুর থানায় হাজিরা দিতে যাইতাম।তখন সেখানে আমরা রবীন্দ্রনাথের একদা আবাসস্থল ঠাকুর কাছারি দর্শন করি। পাবনার বাড়িতে থাকিবার সময় পিতার সংগ্রহিত ৭/৮ শত পুস্তক আমাদের অবসর সময়ের প্রধান অবলম্বন ছিল।এই প্রসঙ্গে মনে পড়িতেছে পিতা মহাশয় রংপুর সাহিত্য পরিষদ,উত্তর বঙ্গ সাহিত্ত পরিষদ এবং বঙ্গিয় সাহিত্ত পরিষদ এর সভ্য ছিলেন।পিতার সাহিত্য প্রীতি এরুপ ছিল যে তিনি তাহাঁর কর্মস্থল নুনখাওয়াতে একটি পাব্লিক লাইব্রেরী বিভিন্ন ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় স্থাপন করিয়াছিলেন।

1 comment:

সুশান্ত বর্মন said...

হ্যাঁ, আমরা এই অমর বিপ্লবীদের অবদান কখনই ভুলব না। দেশমাতার জন্য তাদের যে বলিদান তা কখনও মুছে যাবার নয়।

কুড়িগ্রাম একটি অবহেলিত জনপদ হলেও তার ইতিহাস যে একসময় সমৃদ্ধ ছিল তা আপনার মাধ্যমেই জানতে পারছি। নতুন চোখে কুড়িগ্রামকে নবঃ নবঃ রূপে আবিষ্কার করছি।

তথ্যসমৃদ্ধ পোস্ট দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।